'লাভ লক' ব্রীজ | blogkori
'লাভ লক' ব্রীজ
প্যারিসের যে নদীর পাড়ে বসে কপোতাক্ষ নদ কবিতাটি লিখেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, সেই নদীর নাম শিন। প্যারিসের বুক চিরে শেষ বিকেলের আলোয় ঝলমল করছে শিন। স্থানীয় বাংলাদেশিরা তাই শিন নদীকে কপোতাক্ষ নদ বলে ডাকে। যেখানে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বসে বৈকালিক সময় কাটাতে কাটাতে কবিতাটি লিখেছিলেন, সেই জায়গাটি চিহ্নিত করে রেখেছে ফরাসিরা। এই নিয়ে প্যারিসে আমার সপ্তম যাত্রা। এবার একটি অদ্ভুত জিনিস দেখলাম। শিন নদীর ওপরের একটি ব্রিজ, যার আক্ষরিক নাম বাটোবিস এবং মানুষ বলে লাভ লক ব্রিজ! এই ব্রিজের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, পুরো ব্রিজের দুই পাশের রেলিংয়ে হাজার হাজার তালা মারা! মানুষের এক অদ্ভুত বিশ্বাস, এখানে প্রেমিক-প্রেমিকা বা নতুন বিবাহিত দম্পতিরা তাঁদের ভালোবাসার অমরত্ব চেয়ে মনে মনে ‘উইশ’ করে এখানে তালা লক করে যান!একজোড়া কপোত-কপোতীকে দেখলাম বেশ আগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন তালা দেখছেন।
পরিচয় দিয়ে আলাপ জমালাম। ইতালিয়ানরা ইংরেজিতে আমাদের দেশের চেয়েও দুর্বল। মোটামুটি আকারে ইঙ্গিতে আর ভাঙা ইংরেজিতে জানলাম অ্যান্তিনিও আর রোজি এসেছেন ইতালি থেকে। আট বছরের প্রেমের সফল পরিণতি ঘটবে আগামী মাসে। তাই তাঁরা তাঁদের ভালোবাসার অমরত্বের দাবি নিয়ে এসেছেন এখানে! রোজি হাসতে হাসতে বলেন, অ্যান্তেনিও তাঁর জীবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পুরুষ হিসেবে যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন, এটাই তাঁর আকাঙ্ক্ষা। ভালোবাসা আর বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে ২০০০ সালে প্যারিসের শিন নদীর ওপরে শুরু হয় এই প্রথা। প্রতিবছর নতুন হাজার হাজার তালা এখানে মারা হয়। এসব তালায় নিজেদের নাম খোদাই করে রাখা হয়, কেউবা লিখে রাখেন রং-তুলি দিয়ে। কেউ কেউ সাইকেলের তালাও লক করে গেছেন। সঙ্গে থাকা প্যারিসের বন্ধু জুবের ভাই বললেন, এঁদের প্রেম মনে হয় বেশি জোরালো, এ জন্য সাইকেলের মোটা তালা। নানা রঙের হাজার হাজার তালার ভিড়ে চোখে পড়ল ছোট ছোট ভালোবাসার কোটেশন। যেমন, লিজা, ইউ আর মাই ফেভারিট রিজন টু লুজ মাই স্লিপ! তবে বেশির ভাগ লেখা ফরাসি বা অন্যান্য ভাষায়। একজন সত্তরোর্ধ্ব বয়সী লোক প্রায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন তালায় লেখাগুলো পড়ছেন। পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী দেখছেন? হেসে বললেন, তালায় বিভিন্ন লেখা পড়তে ভালো লাগে। ছয় বছর হয় স্ত্রী মারা গেছেন। আগে স্ত্রীসহ আসতেন বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে। এখানে এসে ভালোবাসাময় একটি বিকেল পার করতেন দুজন মিলে। স্ত্রী মারা যাওয়ার পরও সেই স্মৃতি হাতড়ে এখানে আসেন সপ্তাহে এক দিন। বিভিন্ন তালার লেখাগুলো দেখতে ভালো লাগে। আমি বললাম, এগুলো তো নতুন বছর এলে লোকাল অথরিটি কেটে ফেলে দেয়, তাহলে লাভ কী হলো? লোকটি হেসে বললেন, ‘এটা ভালোবাসা আর বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ মাত্র! কিন্তু এখানে এসে আপনি যে স্মৃতি গেঁথে গেলেন, সেটা কেটে ফেলার সাধ্য কার আছে!’
www.blogkori.tk